অসমন্বয়যোগ্য অগ্রিম আয়কর ও সরবরাহ কর প্রত্যাহার চান সিমেন্ট শিল্প মালিকরা

অস্থিতিশীল এক সময় পার করছে দেশের সিমেন্ট খাত। একদিকে গত এক বছর ধরে করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারির প্রভাব, অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের অস্বাভাবিক ও অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের সিমেন্ট খাতে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের সিমেন্ট খাতের ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখন আর অনুমান করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় অস্তিত্ব সংকটের মুখে থাকা দেশের সিমেন্ট শিল্পকে রক্ষা করতে আসন্ন বাজেটে এই খাতে বিদ্যমান ৩% অসমন্বয়যোগ্য অগ্রিম আয়কর এবং সরবরাহের উপর ৩% কর – উভয়ই সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়েছে এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন (বিসিএমএ)।
পাশাপাশি, সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত মৌালিক কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে নির্ধারিত শুল্ক প্রতি মেঃ টন ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২৫০ টাকায় নির্ধারন করার আহ্বান জানায় বিসিএমএ। এছাড়াও সমন্বিত অগ্রিম আয়কর হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমাকৃত প্রায় ১০০০ কোটি টাকা দ্রুত ফেরত বা ছাড় করার বিষয়েও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে এক বাজেট পূর্ববর্তী সভায় বিসিএমএ-এর প্রেসিডেন্ট মোঃ আলমগীর কবির সংগঠনের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরেন।
মোঃ আলমগীর কবির বলেন, সিমেন্ট একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা যদি কোন দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অথবা উন্নয়ন দেখে থাকি তাহলে সেই দেশের মাথাপিছু সিমেন্ট ও স্টিল ব্যবহার কেমন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। মূলত সিমেন্ট ও স্টিল ব্যতীত কোন দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন একেবারেই অসম্ভব। যেকোন উন্নয়নশীল অথবা উন্নয়নকামী দেশই হোকই না কেন এই দুইটি পণ্যের উপর তাদের গুরুত্ব দিতে হয় বেশি করে। কারণ যারা উন্নতি করেছে, তাদের সাথে যদি একটু তুলনা করি তাহলেই আমরা এর গুরুত্ব বুঝতে পরব। যেমন, চীনে মাথা পিছু সিমেন্টের ব্যবহার ১৭০০ কেজি, মালয়েশিয়ায় ৮৯০ কেজি, থাইল্যান্ডে ৬২০ কেজি, ভিয়েতনামে ৫১৮ কেজি, পার্শ্ববর্তী ভারতে ৩২৫ কেজি, শ্রীলঙ্কায় ৪১২ কেজি এবং বাংলাদেশে ২১০ কেজি।
তিনি বলেন, প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এই খাতে, অথচ গুরুত্ব একেবারেই কম। আমাদের দেশের রাজস্ব আহরণ যারা করে থাকেন, তাদের বেশিরভাগই চেষ্টা করেন সোর্স বা উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ করতে, যেন মাঠ পর্যায়ে যেতে না হয়। তাই পরিধি না বাড়িয়ে উৎসে কর আদায় করার একটি অলিখিত নিয়ম চলছে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে এই পরিধি বাড়াতেই হবে, নয়তো সোর্স বা উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টার্গেট ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যেমনটি ঘটেছে এই সিমেন্ট সেক্টরে।
আলমগীর কবির বলেন, সিমেন্টের সবগুলো কাঁচামালই আমদানি নির্ভর, তাই আমদানি শুল্ক, মূসক ও কর সবই কর্তন হয় আমদানি পর্যায়ে। আমরা বারবার অনুরোধ করে আসছি কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ন্যূনতম প্রফিট বেঁধে দিতে পারেন না। অথচ এই সেক্টরে ৩% অগ্রিম আয়কর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যা সমন্বয় বা ফেরত যোগ্য নয়, অর্থাৎ চূড়ান্ত দায়। এটি গণতান্ত্রিক পন্থায় শুধু ভুল বলবো না, অন্যায়ও বটে।
তিনি আরও বলেন, এই সেক্টরের অন্যতম মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের শুল্কায়ন করা হয় ৫০০ টাকা প্রতি মেঃ টনে যা প্রায় ১১%। অথচ ইন্টারমিডিয়েট কাঁচামাল হিসেবে এটা কোনভাবেই ৫% এর বেশি হওয়া উচিত না। বিগত কয়েক বছরে এই সেক্টরে অগ্রিম আয়কর হিসেবে সমন্বয়যোগ্য বা ফেরতযোগ্য যে অর্থ এনবিআরের নিকট জমা রয়েছে তা আমরা ফেরত পাচ্ছি না। বর্তমানে পুঞ্জিভূত টাকার পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এই সেক্টরে পুঁজি সংকটের এটি অন্যতম কারণ।
অথচ আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ১৪৬ নং সেকশন অনুযায়ী, করদাতার পরিশোধিত টাকা পরিশোধযোগ্য করের চেয়ে বেশি হলে তা ফেরত পাওয়ার যোগ্য। ফেরত দিতে দেরি হলে সরকার যতক্ষন পর্যন্ত না তা ফেরত দিবে ততক্ষন পর্যন্ত তার উপর ৭.৫% হারে সুদ প্রদান করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এ ফেরতযোগ্য টাকাগুলো বছরের পর বছর পরে থাকে এবং বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও তা নগদে ফেরত পাওয়া যায় না।
নভেল করোনা ভাইরাস সিমেন্ট শিল্প খাতে বড় ধরনের আঘাত হানলেও শ্রমিক, কর্মকর্তা বা কর্মচারিদের বেতন-ভাতা কোনভাবেই বন্ধ করা হয়নি বা কমানো হয়নি। তাই পুঞ্জিভুত অগ্রীম আয়কেরর টাকাগুলো দ্রুত ফেরত বা ছাড় করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে আকুল আবেদন জানান শিল্প মালিকরা। এর ফলে অর্থাভাবগ্রস্ত কোম্পানিগুলো কিছু নগদ অর্থের সরবরাহ পাবে এবং এই কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থায়নের খরচ কিছুটা কমিয়ে আনতে পারবে।
বিসিএমএ প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে কিছু পরিমাণ সিমেন্ট রপ্তানি করা হচ্ছে যা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু রপ্তানি পরবর্তী সময়েও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ডেডোতে (উবফড় ড়ৎ উঁঃু ঊীবসঢ়ঃরড়হ ধহফ উৎধনিধপশ ঙভভরপব) জমা দেওয়ার পরেও বছরব্যাপী সিদ্ধান্তহীনভাবে পড়ে থাকে। তাহলে রপ্তানি করার যে উৎসাহ সেটাতো আর থাকবে না।
তিনি বলেন, কর্পোরেট সেক্টর থেকে যে সমস্ত কোম্পানি পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত তাদের কর হার অত্যন্ত বেশি। তার উপর ব্যাক্তির লভ্যাংশ থেকে পুনরায় কর কেটে নেওয়া হয় অর্থাৎ একই খাত থেকে মোটা অংকের দ্বৈত কর থাকার কারণে উদ্যোক্তারা পুঁজি সংকটে ভোগেন অর্থাৎ তাদের ইকুইটি কাঙ্খিত মাত্রায় না থাকায় নতুন কিছু করার সুযোগ থাকলেও তা করতে পারছেন না। এতে মূলত দেশের ক্ষতি হচ্ছে।
শিল্প মালিকদের মতে, বাংলাদেশে সিমেন্ট উৎপাদনের সমস্ত কাঁচামাল বিদেশ নির্ভর, সুতারাং আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য তারতম্য হলে তার প্রভাব দেশে পড়ে। যেমনঃ বিগত ২ (দুই) মাস যাবৎ আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এই মূল্য বৃদ্ধির একটি বড় কারণ পরিবহন বা জাহাজ ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, গত ডিসেম্বর ২০২০ প্রতি মে.টন পরিবহন ব্যয় ছিল ১১ ডলার, যা বর্তমান সময়ে চলছে ২৩ ডলার, এই অবস্থা ভবিষ্যতে কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে তা এখনই কোন অনুমান করা যাচ্ছে না।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সিমেন্ট শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫ টির মতো দেশী বিদেশী কোম্পানী সিমেন্ট উৎপাদন করছে। দেশে সিমেন্টের বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৪ কোটি মেঃ টন যার বিপরীতে প্রায় ৮.৪ কোটি মেঃ টন উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। এখাতে প্রায় ৪২,০০০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। তাছাড়া, এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে কয়েক লক্ষাধিক নির্মাণ শ্রমিক, কর্মচারি ও কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি এখাত থেকে সরকারি কোষাগারে শুল্ক-করের মাধ্যমে জমা করা হয়। দেশে সিমেন্টের সমুদয় চাহিদাই মেটানেরা পাশাপাশি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশেও সিমেন্ট রপ্তানি হচ্ছে।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.